দুর্নীতি একটি সামাজিক ব্যাধি। মানব সভ্যতার এটি চরম অভিশাপ; সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের পথে অন্তরায়। সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকে যুগে যুগেএ জঘন্য ব্যাধির প্রকোপ ও প্রসার দেখা গেছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে আমাদের সকলের জানা দরকার, দুর্নীতি কি এবং মানুষ কেন দুর্নীতি করে।
দুর্নীতি কি?
দুর্নীতি শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো রীতি বা নীতিবিরূদ্ধ আচরণ, কুনীতি, কুরীতি, ন্যায় ও ধর্মবিরুদ্ধ আচরণ ইত্যাদি। এর আরবী প্রতিশব্দ হলো আল-ফাসাদ বা আল-ইফসাদ। আল-কুরআনে এই শব্দটির ব্যবহার এভাবে বর্ণিত হয়েছে,‘‘তারা পৃথিরীতে ফাসাদ সৃষ্টি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, অথচ আল্লাহ তা‘য়ালা ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের কখনই পছন্দ করেন না’’ (সূরা মায়িদা:আয়াত-৬৪)।দুর্নীতি সম্পর্কে অক্সফোর্ড এ্যাডভান্সড লার্নার্স ডিকশনারীতে তে বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে নিজ ক্ষমতা, অর্থ প্রাপ্তি বা কোন অবৈধ সুযোগ প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে অসৎ বা কোন অসঙ্গত কাজে ব্যবহার করাকে বলা হয় দুর্নীতি। এব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যশনাল এর মতে, ব্যাক্তিগত স্বার্থ লাভের জন্য গণপ্রশাসনের অপব্যবহারকেই দুর্নীতি বলা হয়। এক কথায়, সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়ে ঘুষ, আত্মসাৎ, বলপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন বা ব্যক্তি বিশেষের অবৈধ ও অসংগত সুবিধা গ্রহণ এবং নীতি বিরুদ্ধ সকল কাজকেই দুর্নীতি বলা হয়।
প্রশ্ন হলো মানুষ দুর্নীতি কেন করে? দুর্নীতির প্রধান কারণ কি কি?
দুর্নীতির প্রধান কারণসমূহ:
১. জবাবদিহিতার অনুভূতির অভাব : দুর্নীতির অন্যতম কারণ হ’ল জবাবদিহিতার অনুভূতির অভাব। জবাবদিহিতা দু’প্রকার: ইহকালীন জবাবদিহিতা ও পরকালীন জবাবদিহিতা। ইহকালীন জবাবদিহি বলতে জনগণ বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট জবাবদিহিতা বুঝায়। ছলে-বলে-কৌশলে মানুষ অনেক সময় এ জবাবদিহিতা থেকে রক্ষা পায় বলেই দুর্নীতি প্রতিটি সেক্টরেই সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ে। পরকালীন জবাবদিহিতা হলো, কেয়ামতের কঠিন দিনে মহান আল্লাহর সামনে সবাইকে জন্য দাঁড়াতে হবে এবং প্রত্যেকটি দুর্নীর্তির পূঙ্খানপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে।
২. লোভ-লালসা: অতিরিক্ত লোভ-লালসাই হলো দুর্নীতির প্রধান কারণ। হাদিসে এসেছে, দুনিয়ার লোভ হলো সকল অপকর্মের মূল। লোভ প্রধানতঃ কয়েক প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন: দুনিয়ার প্রতি লোভ, মালের প্রতি লোভ, মর্যাদার লোভ এবং পদের প্রতি লোভ। এই সমস্ত লোভের কারণেইমানুষ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। লোভ এমন জিনিষ যার নেশা মানুষকে কবর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। পবিত্র কুরআনে এরশাদ করা হয়েছে, প্রাচুর্যের লালসা তোমাদেরকে গাফেল করে রাখে। এমনকি, তোমরা কবরস্থানে পৌঁছে যাও (সূরা তাকাছুর:১-২)।
৩. বিলাসিতা ও উচ্ছৃঙ্খল জীবন: অল্পে তুষ্ট না থাকা, সাদা-সিধে জিন্দেগী বাদ দিয়ে বিলাসীতায় জীবন-যাপন করা দুর্নীতে জড়ানোর আর একটি অন্যতম প্রধান কারণ। পশ্চিমা ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ, স্বভাব ও কুরুচিপূর্ণ মনোভাব, আধুনিক ও প্রগতিবাদী সাজার অভিপ্রায়ে অনেক মানুষ উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করে থাকে। তাদের চাহিদা স্বাভাবিকের তুলনায় ঢের বেশী। তাদের এই বাড়তি চাহিদা পূরণ করার জন্য অঢেল সম্পদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এরজন্য তারা নীতি বহির্ভূতভাবে সম্পদ অর্জনে হালাল-হারামের পরোয়া না করে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে।
৪. হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করা : দুর্নীতির আরেকটি অন্যতম কারণ হ’ল হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা। অথচ রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘হারাম খাদ্যে গঠিত দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না’(বায়হাক্বী, মিশকাত)।
৫. স্বজন-প্রীতি: শুধুমাত্র আত্মীয়তা, এলাকাপ্রীতি, দল ও গোত্র প্রীতির কারণেও মানুষ দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। এতে অনেক সময় দেখা যায়, দুর্নীতি যে করে তার হয়ত কোন আর্থিক বা অন্য কোন স্বার্থ জড়িত থাকে না, শুধুমাত্র স্বজন-প্রীতিই তাকে দুর্নীতির মতো ব্যাধিতে আক্রান্ত করে ফেলে।
৬. মাত্রাতিরিক্ত অভাব ও কম বেতন দেওয়া: কথায় বলে, অভাবে স্বভাব নষ্ট। প্রয়োজনের তুলনায় ইনকাম খুব কম হলে মানুষ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়তে পারে। তখন সে আত্মসাৎ বা দুর্নীতির ভিন্ন ব্যাখা দিতে থাকে এবং বৈধতায় রুপ দিতে থাকে।
৭. দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া : কোন অপরাধ করা সত্ত্বেও যদি তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হয়, তাহ’লে অপরাধীরা সে অপরাধ করতে আরো বেশী উৎসাহিত হয়। একই কারণে প্রতিটি সেক্টরে আজ দুর্নীতি বিষবাষ্পের মত ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশাসনের চোখের সামনে দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়লেও প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক সময় থাকে নির্বিকার।
৮. দুর্নীতির মাধ্যমে অযোগ্য লোক নিয়োগ : যে সকল চাকুরীজীবি মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে চাকুরী নেয়, তারা চাকুরীতে প্রবেশ করেই ধান্ধায় থাকে কিভাবে প্রদত্ত টাকা ফেরত পাওয়া যায়। তাই তারা ন্যায়-নীতির তোয়াক্কা না করে ঘুষ ও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। আর এভাবেই কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ঘুষ ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। সুতরাং চাকুরী গ্রহণকালে ঘুষ ও দুর্নীতি দূর করা গেলে ঘুষ ও দুর্নীতি অনেকটাই হ্রাস পাবে।
৯. ধর্মীয় শিক্ষার অভাব : দুর্নীতি বিস্তারের অন্যতম কারণ হ’ল যথোপযুক্ত ধর্মীয় শিক্ষার অভাব। ধর্মহীন শিক্ষা মানুষকে স্বার্থবাদী, ভোগবাদী ও স্বেচ্ছাচারী হ’তে প্ররোচিত করে এবং পরকালীন জবাবদিহিতা থেকে উদাসীন হ’তে শেখায়। তাই তারা দুর্নীতি করতে পরোয়া করে না।
দুর্নীতি দেশ ও জাতির জন্য চরম অভিশাপ। দেশের সুনাম-সুখ্যাতি ও মর্যাদা দুর্নীতির কারণে বিপন্ন ও ভূলণ্ঠিত হয়। সুতরাং সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু দুর্নীতি দমন কখনই সম্ভব নয় যদি না সরকার, প্রশাসন ও সমাজের দায়িত্বশীলগণ দ্বীনদার, পরহেযগার ও খোদাভীরু হন। একমাত্র আল্লাহর ভয় ও পরকালীন জবাবদিহিতার অনুভূতিই পারে সমাজকে দুর্নীতি থেকে রেহাই দিতে। (লেখক: মৎস্য বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)।
খুলনা গেজেট/এনএম